বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৩৫ অপরাহ্ন

কৃষকের উন্নতি ছাড়া দেশের উন্নতি সম্ভব নয়

 

 

অমিত হাসান:

 

” সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা,

দেশ মাতারই মুক্তিকামী, দেশের সে যে আশা “

 

রাজিয়া খাতুন চৌধুরানীর লেখা এই কথাগুলো দুনিয়ার আদি থেকে অন্ত সব যুগেই সমানভাবে সত্য । পৃথিবী যতই উন্নত-সমৃদ্ধ হোক না কেন কৃষি এবং কৃষককে বাদ দিয়ে কখনোই আগামীর পৃথিবী কল্পনা করা সম্ভব নয় । সংকটকালীন সময়ে মানুষ চাইলে হয়তো সোশ্যাল মিডিয়া বা ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করেও থাকতে পারে কিন্তু খাদ্যাভাবে থাকা কখনোই সম্ভব না ।

 

বস্তুত কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট চাষি তথা কৃষকেরাই আমাদের খাদ্যাভাব পূরণ করতে নিজেদের সর্বশ্ব উজাড় করে দেন । কখনো শীত সকালে ভোর কুয়াশায় কনকনে ঠান্ডার মধ্যে,আবার কখনো বা তীব্র তাপদাহে,আবার কখনো ঝড়বৃষ্টির মধ্যে অবিরত কাজ করে যান এই মানুষগুলো । তারাই নিজেদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, দিন-রাত পরিশ্রম করে মাঠে ফসল ফলান । তাঁদের সাধনার সেই ফসলে আমাদের অন্নসংস্থান হয়। শুধু তাই নয়, চাষিদের শ্রমে উৎপাদিত ফসল এ দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।

 

কিন্তু আমাদের সমাজ এই মহান পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট লোকেদের প্রাপ্য সম্মান দিতে পেরেছে কিনা সেই প্রশ্ন বহুকালের । মানুষের পাঁচ মৌলিক অধিকারের প্রথমটিই হচ্ছে খাদ্য । আর পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাব হলেই দেশে দেশে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ । আমাদের সুজলা সুফলা এই মাতৃভূমিও বিভিন্ন সময়ে দুর্ভিক্ষে কবলে পতিত হয়েছে । যার বড় কারণ ছিল কৃষি খাত নিয়ে চরম উদাসীনতা ও তীব্র খাদ্য সংকট ।

 

ইতিহাস থেকে জানা যায়,ব্রিটিশরা বাংলার ক্ষমতা দখলের পর ১৭৭০ সালে (১১৭৬ বঙ্গাব্দ) বাংলায় একটি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় । যা পরবর্তীতে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিতি পায় । অতি বৃষ্টি ও বন্যার কারণে কৃষি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় সমগ্র দেশজুড়ে চরম অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয় । ত্রুটিপূর্ণ ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা ও খাদ্যবাজারে দালাল ফড়িয়া শ্রেণির দৌরাত্ম্যের ফলে অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে পড়ে ।

 

তাছাড়া ব্রিটিশ শাসনের একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে বাংলার মানুষকে আরেকটি দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হতে হয়েছিল । ১৯৪৩ সালের (১৩৫০ বঙ্গাব্দ) এই দুর্ভিক্ষটি বাংলা সন অনুযায়ী পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে পরিচিত । বিভিন্ন কারণে ১৯৩৮ সাল থেকে কৃষি ফসলের উৎপাদন কমতে থাকে এবং মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ । তাছাড়া অতিরিক্ত মুনাফাভোগীদের দৌরাত্ম এবং অব্যবস্থাপনা তো ছিলোই ।

তারপর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে বাংলাদেশ এখন কৃষি ক্ষেত্রে সংকট অনেকটা কাটিয়ে ওঠেছে । কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো স্বাধীনতার পর জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বাড়লেও কৃষি জমির পরিমাণ অনেকাংশেই কমেছে । যার অন্যতম কারণ উৎপাদন ব্যায় বৃদ্ধি ও কৃষক পর্যায়ে ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া । তাছাড়া সময়ের সাথে বিভিন্ন আকর্ষণীয় পেশা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ হওয়াতেও অনেকে মাঠ পর্যায়ে কৃষিকাজ থেকে সরে আসছে ।

 

একবিংশ শতাব্দীর এই পর্যায়ে এসে আমরা ভুলে যাচ্ছি জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে জনগণের খাদ্য চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে । তাই উর্বর কৃষি জমি নষ্ট করে সেখানে দালান-কোঠা নির্মাণের অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেশকে বিপদের দিকে ঠেলে দিতে পারে । এ কথা সত্য বাংলাদেশে এক সময় জিডিপিতে কৃষির উপর যে নির্ভরতা ছিল তা ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে । কিন্তু জিডিপিতে কৃষি খাতের সরাসরি অবদান কমে গেলেও এ কথা স্বীকার করতেই হবে কৃষিই আমাদের জাতীয় অর্থনীতির জীবনীশক্তি ।এখনো দেশের একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠী কৃষিকাজের মাধ্যমেই জীবিকা নির্বাহ করে ।

 

কিন্তু কৃষির সাথে সরাসরি জড়িত লোকগুলোর অবস্থাটা আসলে কেমন ? শস্যবীজ, সেচ-কীটনাশক, বীজ বোনা,ফসল ওঠানোর মজুরিসহ পরিচর্যা বাবদ বিঘাপ্রতি সাধারণ কৃষকের যে খরচ হয় ফসল বিক্রি করে তাঁর যথাযথ মূল্য কি কৃষক পাচ্ছে ? বাংলার কৃষকদের বারোমাস্য অনেক প্রাচীন । একসময় যে গোয়াল ভরা ধান ছিল,পুকুর ভরা মাছ ছিল সে কথা এখন আর তেমন একটা শুনতে পাওয়া যায় না । বরং চর্যাপদের ‘হাড়ীত ভাত নাহিঁ নিতি আবেশী’ কিংবা অন্নদা মঙ্গলের ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’—এ আকুতিই শোনা যায় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ।

 

ব্রিটিশ আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালুর ফলে ব্রিটিশ শাসক ও বাংলার কৃষকদের মাঝে কয়েক স্তরের মধ্যস্বত্বভোগী তৈরি হয়েছিল । ব্রিটিশ প্রভু, জমিদার, জোতদার, নায়েব, বরকন্দাজ সবার ‘খাই’মেটাতে উৎপাদক শ্রেণি কৃষক হয়ে পড়েছিল নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর । চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রচলনের পৌনে তিন শ বছর পেরিয়ে আমাদের কৃষকেরা মধ্যস্বত্বভোগীদের সেই ‘চিরস্থায়ী দৌরাত্ম্য’ থেকে কতটা মুক্তি পেয়েছে এখনো সে প্রশ্ন রয়েই যায় । এখনো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সাধারণ কৃষকদের নিজেদের উৎপাদিত ফসল উৎপাদিত খরচের চেয়েও অর্ধেক দামে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হতে হয় । বাজারের নিয়ন্ত্রণকারী সিন্ডিকেট কিংবা করপোরেটদের সঙ্গে সহজ সরল কৃষকেরা প্রতিযোগিতা করবেন কীভাবে ?

 

কৃষকদের দুর্দশা আরো বেড়ে যায় অতিবৃষ্টি,বন্যা,খড়া,নদীভাঙন বা ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে । ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এমনিতেই বাংলাদেশ অত্যন্ত দুর্যোগপ্রবণ এলাকা। তাঁর উপর পুরো পৃথিবীর ন্যায় বাংলাদেশেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে । বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে । এহেন পরিস্থিতিতে সামনের দিনগুলোতে কৃষকদের যে জনগণের খাদ্য জোগান দিতে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না ।

পৃথিবীর বর্তমান আর্থ ও সামাজিক অবস্থায় প্রতিদিনই বিশ্ব বাজারে কৃষি পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং কৃষিপণ্যের দাম সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে । তাই এখনই কৃষিতে বিশেষ নজর দেওয়া জরুরি । কীভাবে দেশে কৃষি পণ্যের উৎপাদন বাড়ানো যায় তা নিয়ে প্রচুর গবেষণার ব্যবস্থা করা উচিত । তাছাড়া যে অঞ্চলের মাটি উর্বর এবং চাষাবাদ ভালো হয় সেই অঞ্চলগুলোয় শিল্প,কলকারখানা তৈরি থেকে বিরত থেকে অপেক্ষাকৃত কম উর্বরতাসম্পন্ন মাটিতে দালান-কোঠা ও শিল্প কলকারখানা স্হাপনের ব্যবস্থা নেওয়া আশু জরুরি ।

 

অমিত হাসান

লেখক ও শিক্ষার্থী

শেয়ার করুন

২০২২ © ডেইলি কালের ধব্বনি কর্তৃক সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত।
Design & Developed by Marshal Host 
akun pro jepang
akun pro rusia
akun pro thailand
akun pro kamboja
akun pro china
akun pro taiwan
akun pro hongkong
akun pro myanmar
akun pro vietnam
akun pro malaysia
link server internasional
link server internasional
link server internasional
pg soft
link server internasional
link server sensasional
pg soft
link server internasional
link server sensasional
pg slot