বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৪৫ অপরাহ্ন
• মু, সায়েম আহমাদ:
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্ম ইসলাম। আল্লাহর কাছে একমাত্র মনোনীত ধর্ম ইসলাম। পৃথিবীর সকল অন্ধকার থেকে আলোয় আলোকিত করার মাধ্যম ইসলাম। ইসলাম সম্পর্কিত এত গুণ থাকার পরেও মানুষ কেন জানি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ বা বিধিবিধান থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখছে। আফসোস হয় ভীষণ আফসোস। আমাদেরকে একটি কথা স্মরণ রাখতে হবে, এই দুনিয়ায় আমাদের বাস ক্ষণিকের; চিরস্থায়ী নয়। পবিত্র কোরআনের ভাষায়,
” জিজ্ঞেস করুন, নভোমন্ডল ও ভুমন্ডলে যা আছে, তার মালিক কে? বলে দিন, আল্লাহ। তিনি অনুকম্পা বা দয়া প্রদর্শনকে নিজ দায়িত্বে লিপিবদ্ধ করে নিয়েছেন। তিনি অবশ্যই তোমাদেরকে কেয়ামতের দিন একত্রিত করবেন। এর আগমনে কোন সন্দেহ নেই। যারা নিজেদের কে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তারাই বিশ্বাস স্থাপন করে না “
সূরা আনআমের ১২ নং এর আয়াতে কিয়ামত অবধারিতভাবে সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে ইঙ্গিত করেছে এবং ঐ দিন সমস্ত মানব জাতির একত্রিত হওয়ার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছে।
আমরা এই ক্ষণিকের দুনিয়ার মায়ায় পড়ে বিভিন্ন রঙ তামাশায় লিপ্ত হই। ভুলে যাই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ এর সকল বিধি-বিধান। ভুলে যাই আমরা মহান প্রভুর স্মরণে এবাদত-বন্দেগি করা। প্রসঙ্গত একটি বাস্তবিক গল্প নিয়েই বলছি। শহর থেকে ঈদ উপলক্ষ্যে বাড়িতে গেলাম। ঈদের পর এক নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে তাদের বাড়ির সামনের মসজিদে নামাজ পড়ার জন্য গিয়ে প্রচন্ড রকমের অবাক হই আর ব্যথিত হয়ে ভাবছি। এত সুন্দর মসজিদ, মসজিদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার জন্য এত এত আয়োজন। বলতে গেলে মসজিদের দিকে তাকালে চোখ ফেরানো দায়। কিন্তু আফসোস, এত সৌন্দর্যে ভরপুর মসজিদে নামাজ আদায় করার জন্য কোন মুসল্লী নেই! জন-মানবশূন্য মসজিদ! থাকলেও এত বড় মসজিদে না থাকার মতোই। আমাদের সমাজের মসজিদগুলোতে এমন জন-মানবশূন্য দৃশ্য দেখে সত্যি ব্যথিত হই। প্রশ্ন জাগে মনে, কী লাভ মসজিদ এত সৌন্দর্যে ভরপুর করে? যদি আমাদের মনের দিক থেকে সৌন্দর্য ফুটে না ওঠে। যদি আমাদের মন আল্লাহর বিধান মেনে চলতে তৎপর না হয়। আহ! বড় আফসোস করে বলতে হয়, বর্তমানে মুসলমান জাতি মসজিদকে উপেক্ষা করে বাজারকে বেশি গুরুত্ব দেয়। মসজিদে না এসে বাজারের দিকে ছুটে যায়। অথচ রাসূল (সাঃ) বলেছেন, সবচেয়ে খারাপ জায়গা হচ্ছে বাজার আর সবচেয়ে ভালো জায়গা মসজিদ। কিন্তু আমরা এই বিষয়ে কোনো তোয়াক্কা করছি না। তাই তো বলতে হয়; এই মন কাঁদে না প্রভুর স্মরণে, কাঁদে শুধু দুনিয়ার লোভনীয় মায়ায়।
আমাদের মাঝে রমজান মাস আসে রহমত, বরকত আর নাজাতের বার্তা নিয়ে। পুনরায় আবার ফিরে যায় কিন্তু এই রমজান মাসের ফজিলত থেকে আমরা কতটুকু শিক্ষা অর্জন করতে পেরেছি? কতটুকু নিজ নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করতে পেরেছি সেটাই মুখ্য বিষয়। এমন বলার কারণ হচ্ছে, রমজানে প্রত্যেক মুসলমান ধর্মের প্রতিটি কাজে সচেতন হয়ে আমল-আখলাকে সোচ্চার হয়ে উঠে। মুয়াজ্জিনের আযান শুনে ছোট-বড় সব বয়সী মুসল্লির পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে মসজিদ। আহ! কী সুন্দর দৃশ্য; তখন মনে হয় ফুল বাগিচায় ফুটে উঠেছে এক একটি ফুল। মানুষ যে কত নিয়মানুবর্তিতার অধিকারী হয়ে থাকে তা রমজানের সময় বুঝা যায়। কিন্তু বড্ড আফসোস হয়। রমজান পরবর্তী সময়ে এমন কিছু আর হয়ে ওঠে না বলে; তখন মানুষ আর রমজানের মত কোন কিছু করার চেষ্টা করে না। হলেও খুব কম মানুষই আল্লাহর রহমত, বরকত আর নাজাত পাওয়ার জন্য ধর্মীয় বিধান নিজ নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করে। যারা এমন কিছু নিজ নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করেন তারাই সফলকাম হন; তারাই আল্লাহর রহমত বরকতের ভাগীদার হন।
আমরা এমন এক মুসলিম জাতি যেখানে বিভিন্ন ধরনের মানুষের বসবাস। কেউ আছে আল্লাহ ওয়ালা, তাকওয়াবান। যারা প্রতিনিয়ত আল্লাহর সকল বিধিমালা অনুযায়ী নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করে থাকেন; এরাই সফলকাম। আবার কিছু আছে যারা নামধারী মুসলমান। এরা রমজান মাস আসলে মুসলমানের ভান ধরে আবার রমজান ফুরিয়ে গেলে নামধারী মুসলমান হিসেবে বিবেচিত হয়। শুধু রমজান মাস নয়; এরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া তো দূরের কথা শুক্রবারের জুমার নামাজেও পাওয়া দুষ্কর। অথচ তারা একটু ভাবে না রাসূল (সাঃ) নামাজের প্রতি কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন। নামায না পড়াকে যারা ছোটখাট বিষয় মনে করেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে বলছি, আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বার বার জোর দিয়ে বলেছেন, “যালিকা ইয়াওমুল হাক্কু” – এই দিন নিশ্চিতই আসবে! যারা নামায পড়বেনা তাদের মাথা পাথর দিয়ে আঘাত করে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেওয়া হবে। আমাদেরকে ফরয নামায ত্যাগ করার আগে চিন্তা করতে হবে, আমি কি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথা বিশ্বাস করি? যদি বিশ্বাস করি থাকি, তাহলে আমি বা আপনি ফরয নামায কোনোমতেই ত্যাগ করতে পারবো না। একটু চিন্তা করে দেখুন তো এই আয়াতে আসলে আল্লাহ কাদের কথা বলেছেন।
এই আয়াতে যাদের কথা বলা হয়েছে এরা আসলে মুনাফেক, মুখে দাবী করে আমরা ঈমানদার অথচ তাদের অন্তরে আল্লাহর প্রতি কোন ঈমান নেই। এদের প্রতি আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক এবং হেদায়েতের আলোয় আলোকিত করুক এই প্রত্যাশা রাখি।
আমাদের সমাজের মসজিদগুলোতে একটি দৃশ্য দেখা যায়। তা হচ্ছে, সামান্য একটু হাঁটাচলা বা দুষ্টুমি করলেই বা উচ্চ স্বরে কথা বললেই ছোট বাচ্চাদের মসজিদ থেকে বের করে দেওয়া হয়। কোন যুক্তিতে আমরা এমনটি করি জানা আছে কারো? কিছু লোক আছে শুধু ছোট বাচ্চাদের প্রতি অস্বাভাবিক আচরণ করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। যা দেখে সত্যিই আফসোস হয়। ফলশ্রুতিতে, ছোট বাচ্চাদের মনে এক ধরনের ক্ষোভ জন্মে। তখন তারা আর মসজিদে যেতে চায় না। অথচ আমরা বুঝতে চাই না তারা এই বয়সে মসজিদ মুখী হয়ে উঠলে পরবর্তী সময়ে এরাই মসজিদে নেতৃত্বে দিবে, এরাই আল্লাহর কাছে প্রিয় বান্দা হিসেবে বিবেচিত হবে। ছোট বাচ্চাদের যদি মসজিদ মুখী না করার নির্দেশ দেওয়া থাকতো তাহলে রাসূল (সাঃ) হাসান-হোসাইন কে কখনোই মসজিদে ঢুকতে দিতেন না। ইমাম হাসান-হোসাইন রাসূল (সাঃ) এর সাথে মসজিদে যেতেন এবং মসজিদে দুষ্টুমি করতেন। যার প্রমাণ মিলেছে নিম্নোক্ত হাদিসে।
” হযরত আবু হােরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত; একদা তাজেদারে রিসালাম, শাহেনশাহে নবুয়ত, নবী করীম (সাঃ) এঁর সাথে ইশার নামায আদায় করছিলাম। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) যখন সিজদায় গেলেন তখন ইমাম হাসান ও ইমাম হােসাইন রাসূল (সাঃ) এর পিঠ মােবারকে আরােহন করলেন। রাসূল (সাঃ) সিজদা থেকে মাথা উঠালেন তখন তাঁদেরকে নম্রভাবে ধরে জমিনে বসিয়ে দিলেন। অতঃপর যখন রাসূল (সাঃ) দ্বিতীয়বার সিজদায় গেলেন তখন ইমাম হাসান ও ইমাম হােসাইন দ্বিতীয়বার এমনই করলো।
এমনকি রাসূল (সাঃ) নামায পরিপূর্ণ করলেন এবং তাঁরা উভয়কে আঁপন রান (কোলে) মােবারকে বসালেন।
[মুসনদে আহমদ,আবু হােরাইরা,৩/৫৯৩,হা/নং ১০৬৬৪, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৫/৫১৬]
এই হাদিসে রাসূল (সাঃ) বাচ্চাদের প্রতি অর্থাৎ ইমাম হাসান-হোসাইনের প্রতি কতটা আন্তরিকতা নিয়ে কাছে টেনে নিয়েছেন। যা সত্যি ভাবনার বিষয়। আমাদের সমাজে যারা মসজিদে বাচ্চাদের প্রতি অস্বাভাবিক আচরণ করে থাকেন তাদেরকে এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। তবুও যদি এমন লোকদের শুভ বুদ্ধির উদয় ঘটে তাহলেই সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যাবে নয়তো ছোট শিশুরা মসজিদ বিমুখ হবে এটাই স্বাভাবিক।
পরিশেষে, মুসলমানদের মনে আল্লাহর ভয়-ভীতি জাগ্রত হোক। ইসলামের সকল বিধিমালা অনুযায়ী নিজ নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করে সেই মনোবল গড়ে তোলার তৌফিক দিক এবং মুয়াজ্জিনের আযান শুনে জন-মানবশূন্য মসজিদ গুলো ফুল বাগিচায় পরিণত হোক। প্রত্যেক মুসলমান পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করার জন্য মনে প্রাণে আগ্রহী হয়ে উঠুক এবং তাদের জীবন যাপনে ইসলামের সৌন্দর্য্যে ভরপুর হয়ে উঠুক। বড়দেরকে অব্যশই ছোট শিশুদের প্রতি স্নেহশীল হতে হবে। তাদেরকে পরম মমতায় আগলে রেখে ইসলামের শিক্ষায় শিক্ষিত হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ফলে, তাদের মনে ছোট্ট বয়স থেকেই নামাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও ভালোবাসার জন্ম নিবে। যেই ভালোবাসার জন্য আল্লাহর রহমতের আশ্রয়ে থেকে তার প্রিয় বান্দাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। ছোট বাচ্চাদের মসজিদ মুখী করার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হবে। হতে পারে সেটা বিভিন্ন উপহার দেওয়ার মাধ্যমে। তবুও তারা মসজিদ মুখী হয়ে উঠুক। আল্লাহ আমাদের মনকে শান্ত এবং তার পথে অবিচল থাকার তৌফিক দান করুক এটাই কামনা করছি।
লেখক: মু, সায়েম আহমাদ
কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক